অভিজ্ঞতার বিড়ম্বনা । The Embarrassment of the Experience

অভিজ্ঞতার বিড়ম্বনা

অভিজ্ঞতার বিড়ম্বনা । The Embarrassment of the Experience


আমি শুনেছি এতটুকু এবং জানতামও তাই যে, পৃথিবীতে বিয়ের অভিজ্ঞতা (Experience) বাদে অন্যান্য যে কোনো কাজের যত অভিজ্ঞতা (Experience)  থাকবে বা আছে, তার প্রয়োজনীয়তা বা মূল্য ততটাই বেশি এবং সম্মানজনক। কিন্তু আজ আমি শেয়ার করব উল্টো চিত্রের একটি ভিন্ন অভিজ্ঞতার (Experience) ফলাফল। সুযোগ পেলেই আমি যেভাবে বলে থাকি, পুষ্ট না হলে যেমন কোনো কিছু খাওয়া যায় না আবার বেশি পুষ্ট হলে সেটা বাতিলের খাতায় চলে যায়। এই যেমন ধরুন ধান, সময়ের আগে খেতে পারবেন না আবার বেশি পুরোনো হয়ে গেলে পোকায় ধরবে, তাও আপনি খেতে পারবেন না। চালের মতো পৃথিবীতে সব জিনিষই একই পরিস্থিতির স্বীকার। তবে এটাতো নিশ্চয়ই ঠিক যে, সময়মতো কেটে আনা মাঠের মোটা ধান বা চালের চেয়ে চিকন ধান বা চালের দাম বেশি। মনে হয় না, কারণ যে চিকন চালের স্বাদ বোঝেনা বা মর্যাদা জানেনা তার কাছে নিশ্চয় মোটা চালটাই বেশি দামী। এতকথা কেনো বলছি? আমার অভিজ্ঞতা (Experience) তাই বলছে। আসুন পরিষ্কার হওয়া যাক। 



আমি ছাত্রজীবন থেকেই শিক্ষকতা জীবনে প্রবেশ করেছি। বাংলাদেশে শিক্ষকতা পেশায় থেকে শিক্ষক হিসেবে পরিচিত হব বা জীবন চালাবো এটা ভাবনাতেই ছিলনা কোনোদিন। আমার চোখে দেখা স্যারদের দূর্দশা দেখে শিক্ষক হওয়ার সাধ কখনই জাগেনি, স্যারদের দেখতাম ইন্ডিয়ান কম দামী সেকেন্ডহ্যান্ড হিরো সাইকেলে চড়তেন তাও আবার সাইকেলের এক চাকার মাঠগার্ড থাকত না, কখনো ব্রেক শো ছাড়াই চালাতেন, আবার কখনো বেল ছাড়া। এছাড়াও সমাজের লোকেরাতো শিক্ষকদের গোণায়-ই ধরতেন না। আর শিক্ষক মানেই গরিব, দুবেলা দু’মুঠো খাবার জোগায় কোনোরকম। কিন্তু ভাগ্যের ঘষাঘষিতে দিন শেষে মাস্টার-ই হয়ে গেলাম। 

একদিকে ভালই লাগছিলো, আমার যা স্বভাব, মোটামুটি স্বাধীন হয়ে চলতে চাই, বেশি বেশি ছুটি কাটাতে চাই, খেলা দেখতে বা করতে যেনো অসুবিধা না হয়, এসব বিবেচনা করলে মোটা চালের ভাত পেটে দিয়ে শিক্ষকতা পেশাটা ভালই লাগে। অনেক বছরের শিক্ষকতা পেশাটাতে অভিজ্ঞতার (Experience) ঝুলি পূর্ণ হতে লাগল। অন্যান্যদের কাছ থেকে শুনে আসছি যে, অন্যান্য পেশার চেয়ে শিক্ষকতা পেশায় অভিজ্ঞতা (Experience) যত বাড়বে ততই ভাল। সেই ভেবে পেশাতে যেমন মনোযোগী হলাম, তেমনি শিক্ষকতা পেশার জন্য যত ধরনের পড়ালেখা বা ট্রেনিং নেওয়ার দরকার সবই মনোযোগী হয়ে নিলাম, বলতে পারেন পিএইচডি ডিগ্রি ছাড়া সবই কমপ্লিট করে ফেললাম। বিদ্যা অর্জনের সুবাদে জুনিয়র শিক্ষক থেকে বড় চেয়ারের দখলেও চলে আসলাম। কয়েকটি প্রতিষ্ঠানের হয়ে চাকুরি করলাম। যে প্রতিষ্ঠানে থাকতাম তার চেয়ে ভাল সুবিধা বা বড় পদ পেয়ে আরেকটি প্রতিষ্ঠানে যেতাম, আবার কয়েকটি বন্ধ হয়ে যাওয়ার কারণেও সেখান থেকে অন্য প্রতিষ্ঠানে যুক্ত হই। কিন্তু কোনো প্রতিষ্ঠানের অপাত্র হয়ে চলে আসতে হয়নি। আমি ভাবতাম কয়েকটি প্রতিষ্ঠানের সাথে কাজ করার অভিজ্ঞতা (Experience) আমাকে আরো সহজে বড় করে তুলবে। কিন্তু বাস্তবে দেখলাম তার ভিন্ন। আমার মাথায়ই আসেনি কখনো, সময় থাকতেও কেউ বেশি পুরোনো হয়ে যাওয়া চালে পোকা ধরার মতো ভেবে নিতে পারে। 

        আমি কয়েকটি প্রতিষ্ঠিত প্রতিষ্ঠানে সাক্ষাতকার দিতে গিয়ে অভিজ্ঞতার বিড়ম্বনায় (The Embarrassment of the Experience) পড়লাম। নিয়োগ বোর্ডের প্রায় সবার পছন্দের তালিকায় থাকলেও প্রতিষ্ঠান প্রধানের প্রশ্ন আপনি বেশ কয়েকটি প্রতিষ্ঠানের সাথে যুক্ত ছিলেন, আপনি অনেক ডিগ্রী নিয়েছেন, তার মানে আপনি কোথাও সন্তুষ্ট না, আপনি একই প্রতিষ্ঠানে কাজ করতে আগ্রহী না। কী আশ্চর্য়!! আরে বাবা, অভিজ্ঞতার (Experience) ভান্ডার কখনই এক জায়গায় এক গন্ডির মধ্যে থেকে সমৃদ্ধ হয় না। সে জন্য নানা জায়গা আর নানান মানুষের সাথে মিশতে হয়। কিন্তু আমি বুঝেও-তো ওখানে বলতে পারিনা। বললেই তর্ক করা হয়ে যাবে। তখনতো বোল্ড আউট। আসলে আমার অভিজ্ঞতা (Experience) ঠিকই কাজে লাগানোর জন্যই হয়েছে, কিন্তু আমার উপরে যিনি থাকবেন তাঁর অভিজ্ঞতা (Experience) এবং যোগ্যতা আমার চেয়েও বেশ কম (গর্ব বা অহংকার করছি না)। তাই তিনি তাঁর ডেপুটি নিয়োগ করতে হাবা বোকাকেই বেছে নিতে চাইছেন। কারণ তিনি জানেন বাংলাদেশের যোগ্য চেয়ারে যেমন বেশির ভাগই কর্তা-ব্যক্তিই অযোগ্য, ঠিক তেমনি তিনিও তাদের একজন। প্রতিষ্ঠান প্রধান যারা হয়ে আছেন, তাদের বেশির ভাগই অনভিজ্ঞ, ব্যকডেটেড এবং অযোগ্য। তাই তাঁরা নিজের চেয়ার ঠিক রাখতেই যোগ্য এবং অভিজ্ঞতা (Experience) সম্পন্ন ব্যক্তিদের পাশে বসাতে চান না। আমার নিজের দেখা সেসব থেকেই বলছি, আমি শিক্ষকতা পেশার জন্য একাডেমিক সর্বোচ্চ পড়ালেখার পাশাপাশিও বিএড, এমএড, কম্পিউটার কোর্স (বাংলাদেশে টেকনিক্যাল শিক্ষা বোর্ড), মোটামুটি সব ধরনের ট্রেনিং (সরকারি ও বেসরকারিভাবে) নিয়েছি এবং প্রতিনিয়ত বিশ্বের সাথে নিজেকে আপডেট রাখছি। আধুনিক প্রতিষ্ঠান প্রশাসক ও পাঠদান নিয়ে কাজ করে যাচ্ছি, কিন্তু তাঁদের চেয়ার দখলের কারণে আমার এই অভিজ্ঞতা (Experience) বা অর্জন অপ্রয়োজনীয় হয়ে উঠেছে। 

        এদেশের শিক্ষা ব্যবস্থার কর্তাদের দেখলে কষ্ট লাগে, হাজারো যোগ্য মানুষ পিছে পড়ে আছে আর অযোগ্যগুলো চেয়ার ঘুরিয়ে নষ্ট করে ফেলছে শিক্ষার মর্যাদাকে। নিজের কিছু যোগ্যতা কাজে লাগিয়ে শিক্ষার বিস্তার ঘটানোর বেশ ইচ্ছে ছিল আগে থেকেই, সে লক্ষ্যে সব রেডি’ও করলাম, কিন্তু এখন সেই যোগ্যতা আর অভিজ্ঞতাই (Experience) কাল হয়ে যাচ্ছে। বেশিরভাগ জায়গাতেই একথা শুনে বাতিল হতে হল যে, আমরা এত অভিজ্ঞ লোক চাই না, অনভিজ্ঞ বা কম অভিজ্ঞ চাই। খুব খারাপ লাগে যে, এদেশের প্রতিটি জায়গায়, প্রতিটি চেয়ারে অসংগতি, যোগ্যতার মূল্য নেই, মূল্য শুধু ক্ষমতার পরিচয় আর তোষামদির তেলের এভাবে চলতে চলতে এদেশের সবই বিলীন হতে চলেছে, আর কত? ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য কি রেখে যাচ্ছি আমরা, তাদেরকে পুরো অন্ধকারে রেখে নিজের ক্ষণিক স্বার্থ এর জন্য সব তছনছ করে ফেলছি। দাঁড়াতে হবে কাউকে না কাউকে বিরোধিতা করার জন্য। তবেই হয়তো দেরতে হলেও কিছু অর্জন  এদেশের হবে।

তবে আপনাকে বলব, যে যাই ভাবুক আপনি কিন্তু থেমে যাবেন না। কারণ সময় থাকতেও আপনাকে বাতিল সেই করবে যার যোগ্যতা আপনার মতো না থেকেও যোগ্য চেয়ার দখল করে আছে। সে জানে আপনি ইন করলে সে আউটের খাতায় পড়ে যাবে। তাই আপনাকে অযাচিত ভেবে কাছে ভেড়াতে সেই ব্যক্তি বাধা হয়ে দাঁড়াবে। 

তবে এইসব অযোগ্য মানুষের আশেপাশে থাকলে ভাবুন বা ভাবতে থাকুন, আপনার সময় থাকতেই পোকাতে ধরছে না তো ? এখন আপনি বলতেই পারেন, লেখাপড়া করে যে গাড়ীর তলে পড়ে সে বা ধৈর্য্য মউতের লক্ষণ। 

ভাল থাকুন আর ভাল রাখুন, অসংগতি জানান, শেয়ার করে অন্যদের পড়ার সুযোগ করে দেন। 

আশা করছি “অভিজ্ঞতার বিড়ম্বনা (The Embarrassment of the Experience)” ভাল লেগেছে। 


সবার জন্য ব্লগ” –এর সাথে থাকার জন্য ধন্যবাদ।


লেখক : মসনদ সাগর
  শিক্ষক, মাস্টার ট্রেইনার, লেখক ও ফ্রিল্যান্সার, 
  by- sobar jonno blog –সবার জন্য ব্লগ ।।।

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ