পুরুষকে কাঁদতে নেই । Men don't have to cry ‍



বর্তমান সমাজে পুরুষের বেহাল দশা, পুরুষকে কাঁদতে নেই, নির্যাতনের শিকার পুরুষ, পুরুষ নির্যাতনের আইন নেই, শত কষ্টেও পুরুষকে কান্না করা নিষেধ, পুরুষ আবার কাঁদে নাকি?
পুরুষকে কাঁদতে নেই

পুরুষকে কাঁদতে নেই । ‍Men don't have to cry

         জীবনের বেলা যখন ছোট ছিল অর্থ্যাৎ ছোটবেলার কথা বলছি, ব্রেইনে যতটুকু বুদ্ধি হয়েছিল সে বুদ্ধি কারো কাজে না আসলেও, তখন বুদ্ধি তৈরি করার জন্য অগ্রজরা যে কথাগুলি বলতেন তার মধ্যে অন্যতম কথা ছিল ‘পুরুষরা কাঁদে না’, একথা শুনে ভাবতাম, বেশ ভালো তো....... এই কান্না নামের ঝামেলাটা পুরুষদের জন্য নয়। আমি বুঝে নিতাম, পৃথিবীতে যত দুঃখ, কষ্ট, জ্বালা-যন্ত্রণা, লাঞ্চনা-বঞ্চনা সব মনে হয় নারীদের জন্যই বরাদ্দ। তাইতো চোখের সামনে যত পুরুষ দেখতাম, বাবা, ভাই, চাচা তাদের কাউকেই কাঁদতে দেখতাম না। যত কান্নাকাটি আর যন্ত্রণার গল্প শুনতাম ঐ নারীদের মুখেই। তারপর জীবন চলতে থাকল। ব্যাখ্যা আকারে বেরিয়ে আসতে লাগলো সে বাক্যের অন্তর্নিহিত রূপ। ব্যস চোখের সামনে বাস্তবতা, আর বুঝে শিখলাম ‘পুরুষকে কাঁদতে নেই’
        সেদিন প্রীতম হু হু করে কেঁদে উঠলো বুক ফাটা আর্তনাদ নিয়ে, আমিতো ‘থ’ হয়ে গেলাম। দৌড়ে কাছে গেলাম, দেখলাম কাঁধে রাখা গামছা দিয়ে দ্রুত চোখের জল মুছছে আর চুলায় চড়ানো রান্না ঠিকঠাক রান্নার চেষ্টা করছে। কিন্তু নোনা পানির স্রোতধারা এত বেশি ছিল যে, প্রীতমের নিজেকে লুকানোর চেষ্টা পুরোপুরি ব্যর্থতায় রূপ নিল। আমি বুঝে উঠতে পারছিলাম না, আমি কি করবো আর এসময়ে কি করা উচিৎ।
       আমি দেবু, সবচেয়ে কাছের এবং পাশের বন্ধু প্রীতমের। ওোর সাথে আমার সম্পর্ক অনেক বছরের। ওোর আপনজনের তালিকায় আমি কত নম্বরে তা ক্লিয়ার না বলতে পারলেও, এটা পরিষ্কার করে দিচ্ছি যে, আমি ছাড়া প্রীতম আর প্রীতম ছাড়া আমি হতেই পারিনা। এত বছরের সম্পর্কে ওোর কাছ থেকে শিখেছি, ভেঙে না পড়া, ন্যায়ের পক্ষ নিয়ে শক্ত হয়ে ঠাঁই দাড়িয়ে থাকা এবং নিজের গতিতে এগিয়ে চলা। যার ফসল হিসেবে আমি এখন সফল মানুষ হওয়ার দ্বারপ্রান্তে।
        প্রীতম কখনো ভেঙে পড়তে পারে বা ভেঙে পড়বে সেটা কল্পনাতেও ছিলনা আমার। কারন জন্ম থেকে মা-বাবা হারানো একটা মানুষ যেভাবে জীবনের প্রতি পায়ে পায়ে যুদ্ধ করে খুব হাসি মুখে নিজেকে সামলে অপরকে সামলানোর পরামর্শ দিত, তা থেকে আজ বিস্তর ফাঁরাক দেখে আমি কিছুটা মুষড়ে গেলাম। জানতে চাইলাম, কি হয়েছে? এমন করছিস কেন ? কেন কাঁদছিস ? বলবিতো আমাকে..... দেখলাম ওো নিজেকে কিছুতেই সামলাতে পারছে না। চেষ্টা করছে চোখে আর জল না আনতে, কিন্তু আমি বুঝতে পারলাম, চোখের জল আটকানোর সাধ্য ওোর বাইরে চলে গেছে। প্রায় ৩ বছর পর ওোর সাথে দেখা হওয়ায় এমন কিছু ঘটে গেছে, যা আমাকে বলতেও পারছে না আবার নিজেকে সামলাতেও পারছেনা। শেষমেশ আমার বুকের মধ্যে মুখ লুকিয়ে ছোট বাচ্চার মতো হু হু করে কাঁদতে থাকলো। কি করে বোঝাবো সে কান্নার বিবরণ। ঠোঁট দু’টো কাঁপছে কিন্তু বুকফাটা কান্না, কান্নার মতো বের হতে পারছে না। কারন, এ যে একজন পুরুষের কান্না, আর ‘পুরুষকে কাঁদতে নেই’ ভুবনের সব পুরুষই হাসি মুখে হাজারো কান্নার কারন গিলে রাখে। জীবনের ঘাণি টানতে যেয়ে রাস্তা-ঘাটে, অফিস আদালতে এমনকি নিজের ঘরেই স্বীকার হয় লাঞ্চনা, বঞ্চনা আর গঞ্জনার। পরিবারের প্রতিটি সদস্যের মুখে হাসি ফোটাতে নিজের সাধ-আহ্লাদ বেমালুম ভুলে যায়। কতজন যে কতভাবে নির্যাতনের স্বীকার হয়, সে হিসেব একজন পুরুষ-ই আন্দাজ করতে পারে। কখনো কখনো প্রচন্ড মনবেদনায় পৃথিবীর মায়া ত্যাগ করতেও বাধ্য হয়। বেশির ভাগ সময়ই পরিবার, সন্তানদের কথা চিন্তা করে ভাগ্যলিখন বলেই এসব যন্ত্রণাকে আড়াল করে ফেলে পুরুষেরা। কারন, বাবা-কে কাঁদতে নেই, স্বামী-কে কাঁদতে নেই, ছেলেকে কাঁদতে নেই... কারন তারা যে পুরুষ। ঠিক সেরকম-ই প্রীতমও না পারছে চিৎকার করে কাঁদতে আর না পারছে চোখের জল সামলাতে। ওোর কান্না দেখে আমার চোখেও জল ঝরতে শুরু করে দিল। দিশেহারা হয়ে পড়লাম। সবচেয়ে কাছের বন্ধুটি এমন করে কাঁদছে মেনে নিতে পারছিলাম না। চূলা নিভিয়ে ওোকে নিয়ে বেডরুমে বসালাম, বললাম আমাকে বল্, কিছুটা হাল্কা হয়ে যাবি। প্রীতম মাথা নেড়ে সম্মতি দিয়ে কিছু বলতে যাচ্ছিল, কিন্তু সে ভাষার শব্দগুলো তার কান্নার সাথে জড়িয়ে দলা পাকিয়ে গলায় আটকে যাচ্ছিল। ভাঙা ভাঙা শব্দে বললো-
দেবুরে....... তুই যে আর কোনদিনই আমার ময়না পাখিটার হাতের রান্না খেতে পারবি না। এ কথা শোনার পর আমি আরো ‘থ’ হয়ে গেলাম আর প্রীতম আবার বাচ্চাদের মতো ঠোঁট ফুলিয়ে কেঁদে উঠল।
কেন ? কী হয়েছে ? আমি খুব হতবাক আশ্চর্য হয়ে জিজ্ঞাসা করলাম। কারন এই দূরে থাকা তিনটি বছর, এমনকি গতকাল আসার আগ মূহুর্তেও এমন কোন খবর শুনি নাই বা আঁচ করতে পারি নাই যে, বন্ধু আমার কোনো অসুবিধায় আছে। আসার পর বউ বাচ্চার কথা জিজ্ঞেস করলে, হাসিমুখেইতো উত্তর দিল যে, ওোরা বেড়াতে গেছে  আর ভাল আছে। কিন্তু প্রীতমের এমন অবস্থা দেখে আমি কোনো ধারনায় করতে পারছি না, আসল ঘটনা কি ?
        যাই হোক প্রীতম এবার কিছুটা স্বাভাবিক হয়ে বলতে লাগলো, দেবু...রে.... সরি... আসলে তোকে এতদিন পর কাছে পেয়ে নিজেকে সামলাতে পারি নাই। তুই যতবার আসতি ততবারই, এমনকি শেষবার যখন এসেছিলি, তখনও তোর সব পছন্দের খাবার ওো-ই তো রান্না করে খাওয়ায়েছিল, কত খুনসুটি করতি ওোর সাথে ভাবী ভাবী বলে, তুই বিয়ে করিস না বলে কত কথা যে মুখ নাড়িয়ে নাড়িয়ে বলতো। একথা বলতেই আবারও কেঁদে দিল প্রীতম। এবার আমি কিছুটা অনুমান করতে পারলাম ওোর ভালবাসার ময়না পাখি রিতু’র কথা বলছে। আমিতো আরো অবাক হয়ে গেলাম। বললাম কেন? রিতুর কী হয়েছে? আর তুইতো আমাকে কখনো ভাল-মন্দ কিচ্ছু বলিস নাই। জিজ্ঞাসা করলেই বাচ্চাসহ ভাল আছিস, তাই-ই তো বলিস। কিন্তু আজ কেন কাঁদছিস ? পুরুষকে কাঁদতে নেই । ‍Men don't have to cry
কি করে কিভাবে তোকে বা তোদেরকে বলবো, সে ভাষায় আমার জানা নেই। আর দূর থেকে শুনে তুই বা তোরা কিছুতেই বিশ্বাস করতি বলে আমার মনে হয়না। এ পর্যন্ত শুনেই আমি পাথরের মতো হয়ে গেলাম। এটাও কি সম্ভব ? প্রীতম-রিতু’র জোটবন্ধন এত তাড়াতাড়ি আলাদা হয়ে যাবে, বিধাতা ছিন্ন করে দিবেন, এ মেনে নেওয়া অসম্ভব। কি বন্ধন আর কি ভালবাসা ছিল ওোদের মধ্যে, পৃথিবীতে দ্বিতীয়টা এমন ভালবাসার স্বামী-স্ত্রী ছিল কিনা? আছে কিনা? হবে কিনা? আমার জানা নেই। প্রীতমের চেয়ে রিতু’র বেশি আগ্রহেই বেশ তাড়াতাড়ি বিয়ে হয় ওোদের। প্রীতমকে হাতছাড়া করতে চায়নি বলেই রিতু প্রীতমের হাতে প্রেমবন্ধনের রশ্মি লাগিয়ে খুব দ্রুত জোড়া লাগিয়ে নিয়েছিল। কারনটা অবশ্য স্পষ্ট, প্রীতমের মতো সুরুচিসম্পন্ন স্মার্ট, ভদ্র ও কর্মঠ ছেলেকে পাওয়া আসলেই ভাগ্যের ব্যাপার। অপরদিকে রিতুও কম যায়না, স্মার্ট, সুন্দরী আর অমায়িক চেহারায় ওোদের দুজনের জুটি বিধাতার অন্যরকম সিদ্ধান্ত।

      যাই হোক, তারপর আমার ধারণামতো বাকিটা শুনতে যেয়ে আমিতো রীতিমতো হতভম্ব। এবার প্রীতম স্বাভাবিকভাবেই বলে ফেলল, রিতু আমাকে ছেড়ে চলে গেছে।
মানে ? চলে গেছে বলতে কোথায় চলে গেছে ?
আমাকে ছেড়ে অন্যের বুকে মহাসুখের জন্য।
আমি কোনটা বিশ্বাস করবো? প্রীতমের কথা, না চোখে দেখা তাদের অন্তহীন সীমার ভালবাসার সংসার জীবন। সত্যি, একদম সত্যি বলছি, এ মূহুর্তেও আমি বিশ্বাস করিনি কিছুক্ষণ পরেই প্রীতম যা বললো। কারন, বিশ্বাস করার কথাও না। তা কি করে সম্ভব হয় ? ফুটফুটে ছেলেটাকে নিয়ে ওোদের সোনার সংসার...................... না, কিছুতেই আমি বিশ্বাসের কাছাকাছি যেতে পারছিলাম না। কিন্তু বাস্তবতা যে আবেগের বিরোধীতা করে। তাই সব শুনে বিশ্বাস করতে হলো আর মেনে নিতে হলো জগৎ সংসারে বিশ্বাস, ভালবাসা, আর দায়িত্বতার ফলও যে বিফল হয়, সেটা।
       প্রীতমের কোন ঘাটতি আমার চোখে আজও পড়েনি, কখনো বাইরে আড্ডা, চায়ের দোকানে বসা কিংবা সংসারের জন্য বিন্দুমাত্র অবহেলা। ছিটেফোঁটা আঁচ লাগতে দিতনা সংসারের দায়িত্ব রিতু’র জীবনে। শুধু অফিস আর বাসা, কাজের প্রয়োজনে বাইরে, তাছাড়া রিতুকে বুকে নিয়েই সারাক্ষণ বাসা, বাসা আর বাসা। একটু বেশি কাজ করতে দিত না রিতুকে, অনেক কিছু খেতে মন চাইলেও রিতুর কষ্ট হবে/গরম লাগবে বলে চুলার কাছে যেতে দিত না, বলতো যতক্ষণ অন্য কাজ করবা ততক্ষণ আমার বুকের মধ্যে কবুতর পাখির মতো চুপচাপ পড়ে থাকো, আর আমি আদর করে দিই। এসব আমার নিজের চোখে দেখা আর কানে শোনা।
       তাহলে গরমিলটা কোথায়? খুঁজতে যেয়ে পেলাম, ওখানেই গরমিল বা প্রীতমের ভুল ছিল। যেহেতু প্রীতম কখনই রিতুকে বুঝতে দিত না, জগৎ সংসারের যন্ত্রণা, আগলে রেখেছিল মা পাখির মতো, পালকের নিচে সযতনে নরম আদরে আর ভালবাসার চাদরে ঢেকে। তাইতো রিতুর কাছে মনে হয়েছে প্রীতম আমার জন্য যা করছে, যে ভালবাসা দিচ্ছে সেটা অতি নগন্য। নিশ্চয় আমার প্রাপ্যতা আরো বেশি। এই পৃথিবী তো ভাল মানুষকে সম্মান দিতে শিখে নাই। যারা কারো উপর যন্ত্রণা চাপাতে চায়না, তাদের উপরেই রাজ্যের দুঃখ ব্যথা চাপিয়ে দিয়ে নিজে পেরেছি বলে খুব বাহবা কুড়িয়ে নেয় বেসামাল এই মায়াময়ী ভুবন।
প্রীতমের এমন অবস্থা শুনে আর একটি শব্দও শুনতে মন চাচ্ছিল না, ঐই ছলনাময়ী, মায়াবতী, ধ্বংসবতী রিতুর কথা। 
বর্তমান সমাজে পুরুষের বেহাল দশা, পুরুষকে কাঁদতে নেই, নির্যাতনের শিকার পুরুষ, পুরুষ নির্যাতনের আইন নেই, শত কষ্টেও পুরুষকে কান্না করা নিষেধ, পুরুষ আবার কাঁদে নাকি?
ছলনাময়ী নারি

পুরুষকে কাঁদতে নেই । ‍Men don't have to cry
 ছিঃ, ধিক্কার জানাই এমন মানুষদেরকে, থুথু ছিটায় তাদের মুখে। আহারে, কি ফুটফুটে রাজপুত্রের মতো ছেলে, যার চেহারার পানে চেয়ে সারাজীবন কোনকিছু না পেয়েও বেঁচে থাকা যায় অনায়াসে। খুব ভালবাসার আর আদরের ধন এই ছেলেটা প্রীতমের। বুদ্ধির পর থেকে বাবা-মাকে না দেখায় এই ছেলেটাকেই আব্বু বলে ডাকতো। কখনো শুনি নাই নাম ধরে ডাকতে। ছেলেটার কথা জিজ্ঞেস করতেই, দেখলাম প্রীতমের চোখ ছলছল, দাঁতে  ঠোঁট চেপে, আবারও সামলানোর চেষ্টা। পরে স্বাভাবিক হয়ে পুরো বিবরণ দিয়ে দিল প্রীতম তার এই পরিণতির। তবুও যে ‘পুরুষকে কাঁদতে নেই’।
       মাঝখানে কয়েকমাস ওোর চাকুরি না থাকায় ন্যূনতম অভাবের ছোঁয়া পেতেই রিতু সংশয়ে নিজের রাস্তা বের করে ফেললো, যদি প্রীতম রোজগার না করতে পারে? প্রায়ই রিতু ঝগড়ায় লিপ্ত হতো ইচ্ছে করেই। ওোর বর্ণনা অনুযায়ী রিতুর স্বার্থপরতা মানবিকতার বাইরে। প্রীতমের শ্বশুড়-শ্বাশুড়ী প্রচন্ড লোভী টাইপের হওয়ায়, তারাও প্রীতমের দূর্দিনে পাশে না দাঁড়িয়ে উল্টো রিতুকে টাকা পয়সাওয়ালা একটা অশিক্ষিত পুরুষের সাথে লেলিয়ে দেয়। আর সেটা প্রীতম বুঝতে পেরে রিতু আর রিতুর পরিবারকে অনেক বুঝিয়েছে, এমনকি বাচ্চাটার মুখের দিকে তাকিয়ে রিতুর পা’য়ে পর্যন্ত ধরেছিল প্রীতম। কোন কাজ হয়নি বরং প্রচন্ড লাঞ্চনা সইতে হয়েছে তাকে। চেষ্টার সর্বোচ্চ দিয়ে যখন আর পারেনি, তখন ৪ বছরের বাচ্চাটাকে নিয়ে শুরু করেছে আর একটি নতুন যুদ্ধ। যে যুদ্ধের লক্ষ্য নিজে ভালো থাকা নয়, অন্যের ভালো দেখে দেখে নিজের জীবনের স্মৃতিচারণ করা। প্রচন্ড একা হয়ে গেছে প্রীতম। যে প্রীতম সবচেয়ে বেশি চটপটে, বুদ্ধিমান আর হাসিমাখা ছিল, সে মানুষটা আজ নির্বুদ্ধিতার এক নীরব প্রতীমায় রূপ নিয়েছে। প্রায় তিন বছর হয়ে গেল সে নীরবে একা একাই থাকে, অফিস আর বাসা। কারো সাথে হাসে না, কথা বলে না, সে কি বিপরীত চিত্র। এসব দেখে আমি জীবনের প্রতি আস্থা, বিশ্বাস হারিয়ে ফেলার দোরগোড়ায়।
ছেলেটা ছোট হওয়ায় বুকের ভালবাসা, দরদ, মায়া-মমতা বিজর্সন দিয়ে মানুষ করার জন্য একটা মাতৃসদনে দিয়ে রেখেছে।
জানিস্ দেবু,  প্রথম প্রথম ছেলেটা খুব কান্নাকাটি করতো, সে তার আব্বু-আম্মুর কাছে ছাড়া আর কারো কাছে থাকবেনা। সারাদিন কাঁদতো,, আমি খুব কষ্ট পেতাম। বুকে পাথর বেঁধে খালি আল্লাহর নিকট জানতে চাইতাম, আমিতো মহাঅপরাধী, আমি না হয় শাস্তির আওতায়, কিন্তু আমার ছেলেটাতো নিষ্পাপ। তার কি অপরাধ? ওো বিধি, বলনা? বিধি কোন জবাব দিত না। শেষমেশ বলতাম, তোর খেলার পুতুল, তুই যেভাবে রাখবি সেভাবেই খুশি আমি। শুধু আমার ছেলেটাকে হেফাজত করিস্।
ছেলেটার কাছে যখন যাই, প্রতিবারই জিজ্ঞাসা করে, আব্বু... ওো আব্বু.. শুধু তুমিই আসো, আম্মু কেন আসেনা? আর আমাকে তোমরা এখানে রেখেছো কেন ? আমি কি খুব দুষ্টুমী করি? তোমাদের খুব জ্বালাই? আমি খুব পঁচা, তাইনা ? ঠিক আছে, আর দুষ্টুমী, আর জ্বালাতন করবো না। আমাকে এখান থেকে নিয়ে চলো, আমি আমার বাসায় যেয়ে ল্যাপটপে গেমস খেলবো, টিভি-তে কার্টুন দেখবো, এই বলে ছেলেটা আমার চলে আসার জন্য রেডি হয়ে যায়। অবুঝ নিরাপরাধ ছেলেটার সরল প্রশ্নের উত্তর দিতে পারিনা রে দেবু..... বুকের মধ্যে নিয়ে জাপটে ধরে কাঁদতে থাকি আর মনে মনে বলি, তোর মা আর আসবে না রে... কখনই আসবে না, সেতো মহাসুখের আশায় তোকে আর আমাকে একা করে চলে গেছে। আমি তোর হতভাগা ব্যর্থ বাবা, আমিই খুব খারাপ। কারন মা’য়েরা কখনো খারাপ হয়না, তাদেরকে খারাপ বলা যায়না, বলা নিষেধ। পৃথিবীতে সকল বাবা খারাপ উপাধী পেলেও একটি মা’কেও খারাপ বলা যাবে না, যায়না কারন তারা যে মায়ের জাত। তারা কখনই খারাপ হতে পারে না। এখনও আগের মতো বাসায় আসি। বেমালুম ভুলে যাই অনেককিছু, তাইতো দোকন থেকে ছেলের পছন্দের খাবার কিনে ফেলি। মনেই থাকেনা, আগের মতো কলিং বেল চেপে কিছু সময় দাঁড়িয়ে থাকতে হবে না, নিজেকেই ঝুলে থাকা তালা খুলে চারদেয়ালে প্রবেশ করতে হবে। ভুলেই যাই, কলিং বেল এর শব্দ শুনে ‘আমার আব্বু আসছে, আমার আব্বু আসছে’ এই বলে উলঙ্গ শরীরে দরজা খোলার জন্য আমার ছেলেটা দৌড়ে আসবে না। সারাদিন পর বাসায় আসলে আর বিচার শুনবো না ছেলেটার। কত যে বিচার ওোর মায়ের নামে, সারাদিনে পিটুনি দিছে, কিচ্ছু  খেতে দেয়নি ইত্যাদি ইত্যাদি।
এসব কথা বলতে বলতে প্রীতম ছোট বাচ্চাদের মতো এবার হাই-মাউ করে কেঁদে ফেললো। কিন্তু ‘পুরুষকে কাঁদতে নেই’। বুঝতে আর বাঁকি রইলো না প্রায় ৩ বছরের জমে থাকা কষ্ট কাউকে বলতে না পেরে, আজকে আমাকে পেয়ে কষ্টের কিছু অংশ বুক ফেটে বের হয়ে যাচ্ছে।
কিছুটা সময় নীরবে ভাবলাম, হায়রে জীবন..... রিতুর সাজানো সংসার সবই ঠিক আছে, ছেলেটার খেলনা, ল্যাপটপ, কম্পিউটার সবই আগের মতোই পড়ে আছে, শুধু সেখানে হাত পড়েনা ছেলেটার। আশেপাশে ধূলো-ময়লা দখল করে নিয়েছে। সাথে কষ্টের মাকড়সাও পুরো দখলে নিয়েছে প্রীতমের অন্তর, হৃদয়, কলিজা আর মমি’র মতো হয়ে যাওয়া দেহটাকে।
      আমি বাকরুদ্ধ, আমি হতভম্ব, আমি নির্বাক। একজন পুরুষকে নীরবে এতটা গঞ্জনা সয়ে হাসিমুখে অভিনয় করে যাওয়াটার শাস্তি খুব বেশিই মনে হলো আমার কাছে। তাই বিধাতার কাছে প্রার্থনা, পুরুষকে হাউ-মাউ করে, চিৎকার করে কাঁদতে অধিকার দিয়ে দাও, নয়তো তোমার বিচারের নিরপেক্ষতা নিয়ে আমার মতো দেবু বা দেবুরা প্রশ্ন তুললে, তুমি বিধাতা শাস্তি দিলে সে শাস্তির মাঝে ‘?’ চিহ্ন রয়েই যাবে। আজ প্রীতমকে দেখে ছোটবেলার শোনা সেই বাক্যের মর্মার্থ একশো-তে একশো পরিপূর্ণ।

সত্যিই চিরচারিত স্বার্থক বাক্য একটি-

পুরুষকে কাঁদতে নেই । ‍Men don't have to cry


ধন্যবাদান্তে;


লিখেছেন : মসনদ সাগর
শিক্ষক, মাস্টার ট্রেইনার, লেখক ও ফ্রিল্যান্সার, 

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ